
বিশেষ প্রতিবেদন
যুদ্ধের ময়দানে সালাহ উদ্দিন মমতাজকে সহযোদ্ধারা ডাকতো “রিয়েল টাইগার” নামে। বিখ্যাত কামালপুর যুদ্ধের মহানায়ক তিনি। যে কামালপুর যুদ্ধের রণকৌশল ও তার বীরত্বগাঁথা আজও পাঠদান করা হয় বিশ্বখ্যাত সব সামরিক কলেজে।
মেজর সালাহ্ উদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম) ১৯৪৫ সালের ১২ জুলাই ফেনী সদর উপজেলার পৌরসভার ১২ নং ওয়ার্ড উত্তর চাড়ীপুর মোক্তারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আকিয়াবের শেষ মুসলিম জমিদার। আর নানা ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য। শামসুদ্দিন আহমেদ আর খায়রুন নাহারের বড় আদরের ছেলে সালাউদ্দিন। শেষের নামটি দাদার নামের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া। সন্ধ্যে নামলেই ঘরে ঘরে কুপিবাতি। ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে উঠোনের এক কোনে সাদা কাপড় গায়ে চাপিয়ে ভুতের ভয় দেখানোর সেকি নিরন্তন চেষ্টা তার। একবার হলো কি বেড়াতে আসা খালাতো বোন সাদা কাপড় গায়ে লম্বা মতো মানুষ দেখে অজ্ঞান। এমনই চলছিল জীবন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ছিলেন পাকিস্তানের ৪৩ বেলুচ রেজিমেন্টে কর্মরত। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ খায়রুল আনাম, ক্যাপ্টেন সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ দুর্গম পার্বত্য এলাকা এবং পাকিস্তানের শিয়ালকোটের কাছে মারালা সীমান্তের খরোস্রোতা মুনাওয়ার তায়ী নদী অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। এই নদী অতিক্রম করে সীমান্ত পাড়ি দেয়া ছিল প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক।
২৮শে জুলাই রাতে ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ও তাঁর দলের লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান, সুবেদার হাই, সুবেদার হাসেম ও নায়েক সফিকে নিয়ে কামালপুর বিওপি রেকি করতে যান। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পাকিস্তানি লিসনিং পোস্টের কাছাকাছি পৌঁছালে একজন পাকিস্তানি সেনা ‘হল্ট’ বলেই চিৎকার দিয়ে উঠেন। ঐ সময়ে লিসনিং পোস্টে দুই সেনা সদস্য ছিলো। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ তখন এক সৈন্যকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেন। এসময় সুবেদার হাই গুলি করেন। মুহুর্তেই দুই পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ঐ দুই সৈন্যকে একপাশে ফেলে তাদের ক্যাপ ও রাইফেল নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ও বাকি চারজন।
এদিকে হঠাৎ আক্রমণ ও দুই সেনার নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ণ সতর্ক হয়ে যায়।
৩১শে জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশনে যাওয়ার আগেই অতর্কিত ভাবে ভারতীয় মাউন্টেন ব্যাটারি কোন নির্দেশ ছাড়াই গোলাবর্ষণ শুরু করে। এদিকে পরিকল্পনা ছিলো ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজ এফইউপিতে পৌঁছে নির্দেশ দিলে তবেই ভারতীয় মাউন্টেন ব্যাটারি গোলাবর্ষণ শুরু করবে। কিন্তু ভুলবুঝাবুঝির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি বাহিনীকে চমকে দেয়া সম্ভব হলোনা। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান আঁচ করতে পেরে গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো। এদিকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর একটি গোলাও দুর্ভেদ্য হানাদারদের অবস্থানে পৌঁছাচ্ছে না। এ কারণে ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানির মধ্যে শত্রুদের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা করা অসাধ্য হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানি কোনভাবে অবস্থান নিয়ে শত্রু বাঙ্কার অভিমুখে আক্রমণ শুরু করলো।
পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি দেখতে পাচ্ছে। এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই বিকল হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক। এদিকে সংকেতের কারণে আর্টিলারি ফায়ার বন্ধ ও সম্ভব হচ্ছেনা। আর নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও বন্ধ হয়ে যায়। তীব্র গলাগুলি ও পাল্টা গোলা বর্ষণের তীব্র আওয়াজে শুধু চিৎকারের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষাও ভয়াবহ কঠিন হয়ে পড়ে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের ডেল্টা কোম্পানি ও ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানি ও মুক্তিযোদ্ধারা ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে এফিউপিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এদিকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের ও পাকিস্তানিদের ক্রসফায়ারে আহত হন। সাময়িকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের গতি থেমে যায়। এই অবস্থায় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ অসামান্য নেতৃত্বের পরিচয় দেন। তিনি ক্ষেপে গিয়ে হাতের কাছের সেনাদের কাউকে ধাক্কা মেরে, কারো গোলা চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকেন। চরম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে তিনি শত্রুদের লক্ষ্য করে মাইক্রোফোনে উচ্চ কণ্ঠে উর্দুতে বলতে থাকেন ‘আভি তাক ওয়াক্ত হ্যায়, শালালোক সারেন্ডার কারো, নেহি তো জিন্দা নেহী ছোড়েঙ্গা।’ (এখনই সময়, সবাই সারেন্ডার কর, নয়তো একজনকেও জীবিত ছাড়বো না। ) সহযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য তিনি বলতে থাকেন, ‘ইয়াহিয়া খান এখনও এমন বুলেট তৈরি করতে পারেনাই, যা মমতাজকে ভেদ করবে যদি মরতেই হয়, এক পাকসেনাকে সাথে নিয়ে মরো। বাংলার মাটিতে শহীদ হও।’
ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের প্রেরণায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হারানো মনোবল ফিরে আসে। বিপুল বিক্রমে ঘুরে দাঁড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা। সালাউদ্দিন মমতাজের অসীম সাহসিকতায় তাঁর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে পাকিস্তানিদের ১ম ডিফেন্স কর্ডন শেল প্রুফ বাংকারে ঢুকে পড়েন। এ সময় সালাউদ্দিন মমতাজ আরও সাহসী হয়ে উঠে ২০-২৫ জনকে নিয়ে বিওপির কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে যান। তিনি বুঝতে পারেন পাকিস্তানিরা সামনের সারির বাংকার পজিশনগুলো ক্লিয়ার করে পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় সেকেন্ড লাইনে কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তিনি মেগাফোনে সুবেদার হাই এর প্লাটুনকে ডানদিকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ করে বলেন ‘হাই প্লাটুন নিয়ে ডানে যাও।’ আক্রমণের শুরুতে সুবেদার হাইয়ের প্লাটুনে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৪০ জন। আর এই পর্যায়ে এসে তাঁর প্লাটুনে মুক্তিযোদ্ধা ১৫ জনের মতো। এদিকে মাইনের আঘাতে নায়েক শফির হাত উড়ে গেছে। অগ্রসরমান মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনকে বারবার পিছু হটার জন্য অনুরোধ করে বলতে থাকেন ‘স্যার পজিশনে যান, স্যার পজিশনে যান। এখানে জায়গাটা প্রচন্ড বিপজ্জনক।’
সালাউদ্দিন মমতাজ ধমকে উঠে বললেন, ব্যাটা বারবার স্যার স্যার করিস না। পাকিস্তানিরা আমার অবস্থান টের পেয়ে যাবে। চিন্তা করিস না তুই আমার সামনে এসে দাঁড়া। গুলি লাগবে না। ইয়াহিয়া খান আজো আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি। প্রথমবারে সম্ভবত সুবেদার হাই ম্যাগাফোনে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের নির্দেশ শুনতে পান নি, তাই সালাউদ্দিন মমতাজ পুনরায় সুবেদার হাই’কে উদ্দেশ্য করে বলেন ‘হাই’… ঠিক এমন সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের সামনে কয়েকটি গোলা এসে পড়ে বিস্ফোরিত হলো। তাঁর দেহটা প্রথমে বামে, পরে আধা ডানে, এবং শেষে লুটিয়ে পড়ে শেষবারের মতো। এসময় সহযোদ্ধারা তাঁর দিকে এগিয়ে এলে তিনি বললেন, ‘খোদার কসম তোরা কেউ পিছু হটবি না।’
বিড়বিড় করে তিনি বললেন, ‘মরতে হয় পাকিস্তানিদের মেরে মর বাংলাদেশের মাটিতে মর।’ শহীদ হলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সন্দেহাতীতভাবে অপারেশন কামালপুরকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। কামালপুর যুদ্ধের সবচেয়ে দুরূহ ও বিপজ্জনক যুদ্ধ ছিলো ৩১শে জুলাইয়ের এই যুদ্ধ।
কামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিলো প্রচন্ড সুদৃঢ়। বিশেষ করে কামালপুর বিওপির চারদিকে মোটা গাছের গুঁড়ি ও কংক্রিট দিয়ে আর্টিলারি শেষ প্রতিহত করার জন্য মাটি- টিনের দেয়াল এবং ৬ ইঞ্চি ব্যবধানে লোহার বিমের মোট ৮টি উঁচু বাংকার ছিল আর বাঙ্কারের বাইরের অংশে পুঁতে রাখা ছিল মাইন, কাঁটাতারের বেড়া, বুবি ট্র্যাপ ও বাঁশের কঞ্চি।
কামালপুর বিওপির তখন সিও ছিলেন ক্যাপ্টেন আহসান মালিক। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডার আহসান মালিক ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের পাকিস্তানে সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ের সহকর্মী ও সহপাঠী। সালাউদ্দিন মমতাজের সহমুক্তিযোদ্ধারা ধারণা করেন হয়তো ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের নির্দেশেই সালাউদ্দিন মমতাজের লাশ সরিয়ে নিয়ে কোনো এক অজানা স্থানে তাকে দাফন করা হয়েছিল।
শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন দুর্র্ধষ বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।
আজ মহান স্বাধীনতা দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি কিংবদন্তি শহীদ সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তমকে।