
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি
এক সময় কোরবানির ঈদে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভার ধবল (সাদা) গরু। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন এই গরুর চাহিদা এতো বৃদ্ধি পেয়েছে যে, হাটে তোলার আগেই খামার থেকেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এ সমস্ত গরু।
আগে শুধু পুরান ঢাকায় চাহিদা থাকলেও এখন এ গরুর চাহিদা বেড়েছে সমগ্র দেশজুড়ে তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গরু ক্রেতারা এ সমস্ত গরুগুলো খামারেই এসে কিনে নিয়ে যায়। ইতোমধ্যে মিরকাদিমের খামারগুলো থেকে গরু বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। ক্রেতারা গরু কিনে খামারেই রেখে যাচ্ছে ঈদের দু-একদিন আগে নিয়ে যাবেন বাড়িতে।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিমের এই গরুর খামারগুলোর পাশেই রয়েছে বিশাল বিশাল চাল, কুড়া, ভূসি, খৈলের আড়ৎ। এ সমস্ত আড়ত মালিকরাই আড়তের আশপাশে গড়ে তুলেছেন গরুর খামার। নিজস্ব খামারের মীরকাদিমের ভুসি, কুঁড়াসহ বিভিন্ন উন্নতমানের গোখাদ্য মিনিকেট চালের খুদ, এক নম্বর খৈল, ভাতের মাড়, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভুসি, গমের ভুসি, বুটের ভুসি খাওয়ানো হয় গরুগুলোকে। এছাড়া গরু পালনে প্রশিক্ষিত লোক নিয়োগের মাধ্যমে গরুগুলো পালন করা হয়।
খামারিরা জানান, এই গরু পালনে কোনো রকম ইনজেকশন বা গরু মোটাতাজাকরণের ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। খামারিদের নিজস্ব মিলে ভাঙানো খৈল, বিভিন্ন প্রকার ভুসি, কুঁড়া, চালের গুঁড়া খাইয়ে পরম মমতায় লালনপালন করা হয় এই গরুগুলোকে। খামারের ভেতরের পরিবেশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। বাইরের কাউকে খামারের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হয় না।
মিরকাদিমের ধবল গরুর বৈশিষ্ট্য হলো এ সমস্ত গরুর চোখের পাপড়ি সাদা, নাকের সামনের অংশ সাদা, পায়ের খুর সাদা, লেজের পশম ও সারা শরীর সাদা। এই সমস্ত ধবল গরুগুলো দেখতে যেমন সুন্দর তেমন মাংস খুব সুস্বাদু। এই সাদা গরুগুলো সাধারণত এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের হয়ে থাকে। মুন্সীগঞ্জের কোনো হাটে এই গরু বিক্রি হয় না। আগে পুরান ঢাকার হাটে নিয়ে গরুগুলো বিক্রি করতো খামারিরা। এখন পুরান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ মিরকাদিমে এসে গরু ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে মিরকাদিমের বেশ কিছু খামার ঘুরে দেখা যায়, বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খামারগুলোতে লালন-পালন করা হচ্ছে গরু। মজিবুরের খামারে মোট ৫১ টি গরু আছে। এর মধ্যে ধবল জাতের গরু রয়েছে অর্ধেকের বেশি। গত বছর এই খামারে অবিক্রিত গরু ছিল ৬টি। বাকি গরুগুলো গত কোরবানি ঈদের পরে কিনে এনে খামারে লালন পালন করছেন।
ওই খামারের দেখভালের দায়িত্বে আছেন তিনজন। এর মধ্যে জিয়াউর হক নামে একজন বলেন, কয়দিন আগে যে গরম গেল ওই সময় গরুগুলোর খুব কষ্ট হচ্ছিল। গরমে বেশ কিছু গরু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সে সময় গরুগুলোকে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। এখন গরম কমায় গরুগুলো ভালো আছে। ইতোমধ্যে খামার থেকে ১১টি বিক্রি হয়েছে। যারা কোরবানি দেয় তারাই এখান থেকে গরু কিনে খামারে রেখে গেছেন। পরে কোরবানির দু-একদিন আগে এসে নিয়ে যাবেন।
মীর কাদিম শাহিনের খামারে মোট ৫১টি গরুর মধ্যে অন্য জাতের আছে মাত্র ৫টি। ৪৬টি সাদা ধবল জাতের গরু।
ওই খামারের শ্রমিক রফিক মিয়া বলেন, গত বছর কোরবানির পর এই গরুগুলো আমরা ফরিদপুর জেলার টেপাখোলা বাজার হতে কিনে এনেছি। প্রায় গরুই এক লাখ টাকার ওপরে দাম দিয়ে কিনে এনে লালন-পালন শুরু করি। সামনের কোরবানিতে গরুগুলো বিক্রি করব। এ পর্যন্ত খামারের ছয়টি গরু বিক্রি হয়ে গেছে। সেগুলো দুই লাখ থেকে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। ঈদের আগে বাকি গরুগুলো খামার থেকে বিক্রি হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে ওই এলাকার মজিবুর রহমান বলেন, আমাদের নিজেদের মিল আছে। আবার খামারও আছে। আমরা আমাদের নিজেদের মেইলের খৈল, কুড়া, বিভিন্ন ধরনের ভূসি, ভুট্টা উন্নত মানের খাবার খাইয়ে আমাদের খামারের গরুগুলো লালন পালন করে থাকি। কোনো ইনজেকশন দেই না কোনো ভেজাল খাবার খাওয়াই না। যার কারণে আমাদের গরুর মাংসগুলো খুব সুস্বাদু হয় এবং এগুলো চাহিদা খুব বেশি। ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চাদঁপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকার আশে আমাদের এখান থেকে গরু কিনতে।
মীর কাদিম এগ্রো খামারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা মিন্টু মিয়া বলেন, আমাদের খামারে গরু আছে ১৩০টি। এর মধ্যে ৬০টি কোরবানির ঈদে বিক্রি করা হবে। আমরা মূলত খামারে দুগ্ধ উৎপাদন করি সেই সঙ্গে বিক্রির জন্যও গরু প্রস্তুত করি। আমরা যে সমস্ত গরু মোটতাজাকরণ করি ওগুলো মূলত আমাদের খামারেই উৎপাদন হয়। আমরা মা গরুগুলোকে উন্নতমানের বীজ দিয়ে এখানে গরুর বাচ্চা উৎপাদন করি মা গরুর দুধ বাজারে বিক্রি করি এবং বাছুরগুলোকে লালন পালনের মাধ্যমে বড় করে বিক্রি করে থাকি। আমাদের খামরে প্রায় ১০টি গুরু আছে যেগুলোর ওজন ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি। এ গরু বাছুর গুলো আমরা খামারেই উৎপাদন করেছি।
অপর শ্রমিক আরিফ বলেন, আমাদের খামার থেকে ইতোমধ্যে ৫টি গরু বিক্রি হয়ে গেছে। তবে ওই এলাকার খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিরকাদিম পৌরসভার কুলুপাড়ার ধবল গরু লালন পালন করার যে ঐতিহ্য ছিল তা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। খামারে গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কালের বিবর্তনে মীরকাদিমের বিখ্যাত ধবল গরুর ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। ভেজালযুক্ত খাবার দিয়ে গরু মোটাতাজা করে দ্রুত আঙল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে কিছু অসাধু খামারি। ফলে ২০০ জনের বেশি ধবল গরুর খামার মালিক থেকে এখন ১৫/২০ জনে নেমে এসেছে।
এ সমস্ত ধবল গরুগুলো মূলত কুড়িগ্রাম জেলার ভূরাঙ্গামারীসহ বিভিন্ন হাট ও এলাকা থেকে ভারত ও ভুটানের আবাল-পশ্চিমা সাদা ষাঁড় ও সাদা গাভীর বাচ্চাসহ কিনে আনেন মীরকাদিমের খামারিরা। লাভ লোকসানের কথা চিন্তা না করেই পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখে গরু পালন করেন। বাবা-দাদাদের ধবল গরু পালনের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন খামারিরা।
মুন্সীগঞ্জ প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, মুন্সীগঞ্জের খামারগুলোতে মূলত দেশি গরু বেশি দেখা যায়। এ জেলায় মোট ৫ হাজারের মতো খামার রয়েছে। এর মধ্যে মিরকাদিমের গরুগুলোর চাহিদা বেশি। কোরবানির আগে ৬ মাস হতে এই গরুগুলোকে মোটাতাজা করতে শুরু করে খামারিরা। এই মোটা তাজাকরণ কাজে তারা গরুগুলোকে সবচেয়ে বেশি সবুজ ঘাস খাইয়ে থাকে। খৈল নানা ধরনের ভূষি, চালের খুদ খাওয়ায় এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। মূলত স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তারা গরু মোটা তাজাকরণ করায় এগুলো দেখাতে সুন্দর আকর্ষনীয় ও মাংস সুস্বাদু হয়। তাই এগুলোর চাহিদা বেশি। মিরকাদিমের খামারিরা কখনো মোটতাজাকরণ ট্যাবলেড, ইনজেকসুন, হরমোন ওষুধ ব্যবহার করে না। যার কারণে এগুলো স্বাস্থ্যসম্মত ও সুস্বাদু হয়।