সৈয়দ মুশফিকুর রহমান
বাংলাদেশের প্রায় এক-দশমাংশ আয়তন জুড়ে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান- এ তিন জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত। এ তিন জেলার আয়তন প্রায় ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৮,৪২,৮১৫ জন। মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাকি অর্ধেক বাঙালিদের বসবাস। দীর্ঘ আড়াই দশক থেকে চলে আসা পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ঘটে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসান ঘটে, সূচিত হয় শান্তির পথচলা। শান্তি চুক্তির পরে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম যে একবারে শান্ত হয়ে গিয়েছিল তা কিন্তু বলা যাবে না। তবে শান্তি চুক্তির পর পার্বত্য জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। জনসংহতি সমিতির সাথে পাহাড়ি অন্যান্য সংগঠন বিশেষ করে ইউপিডিএফসহ নানা সংগঠনের কিছু বিরোধ আগে থেকেই ছিলো। পার্বত্য অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই কিন্তু একেবারে থেমে যায়নি। অপহরণ ও চাঁদাবাজি নিয়ে মাঝে মাঝে দুটি সংগঠণের ঠান্ডা লড়াইয়ে এই জনপদ রক্তাক্ত হওয়ার খবর সবারই জানা। এরই মধ্যে ২০১৭ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ গঠিত হওয়ার পর থেকে বান্দরবান জেলাসহ গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন আতংক ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা, অপহরণ, জনপদে ঢুকে ব্যাংক ডাকাতিসহ এই রকম সশস্ত্র উপস্থিতি জানান দেওয়া কোনভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা ও ব্যাংক ডাকাতি এখন সারাদেশের প্রধান আলোচিত বিষয়। কেএনএফকে নিয়ে গত তিন সাপ্তাহ ধরে মিডিয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এবং দেশের সচেতন নাগরিক সমাজে আলোচনা বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করার মতো। গত ২ এবং ৩ এপ্রিল বান্দরবান জেলার দু’টি প্রধান উপজেলা রুমা এবং থানচিতে পরপর দু‘দিন কেএনএফের ভয়ঙ্কর তান্ডবে বান্দরবানে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ৭০ জনের মতো সশস্ত্র ব্যক্তি উপজেলা সদরকে নিয়ন্ত্রণ করে দু’টি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি করে, নিরাপত্তা রক্ষী ও আনসারের ১৪টি অস্ত্র লুট করে। একজন ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে সারাদেশে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিনের এমন বেপরোয়া কর্মকান্ডে পার্বত্য অঞ্চলের জনজীবনে নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও চরম হুমকি।
আশি ও নব্বই এর দশকে তিন পার্বত্য জেলায় যারা সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলো তারাই আবার গোপনে কেএনএফ সন্ত্রাসীদেরকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। পার্বত্য অঞ্চলে বিদেশি এনজিওগুলোর কার্যক্রমও প্রশ্নবিদ্ধ। এনজিওর কার্যক্রমের উপর নজরদারি প্রয়োজন। এ অঞ্চলের কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর লোকজন মূলত খ্রিষ্টান। ভারত ও মিয়ানমারের কুকি চিন জনগোষ্ঠীও খ্রিষ্টান। এ অঞ্চলের খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে প্রতিবেশি ও আন্তর্জাতিক মহলের কোনো ইন্দন আছে কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
২০১৭ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ গঠিত হওয়ার পর থেকে বান্দরবান জেলাসহ গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্নভাবে আতংক ছড়িয়েছে; বিশেষ করে অপহরণ, চাঁদাবাজি, হত্যা, জঙ্গিদের ট্রেনিং দেওয়া এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করার কারণে কেএনএফ গোটা বাংলাদেশে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৯৭ সালের পর থেকে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বনাম ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর মধ্যে করা দ্বন্দ্ব-সংঘাত যেভাবে মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে, ২০১৭ সালের পরে কেএনএফ সেটা রীতিমতো নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কুকি-চিন আসলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। পাহাড়ি-বাঙালিসহ সকলের মনে প্রশ্ন, সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা ও ব্যাংক লুটের সাহস পেল কোথায়? শান্তিচুক্তি বিরোধী এই সংগঠনের সাথে যখন সরকারের শান্তির আলোচনা চলমান, তখন এই ধরনের হামলার মাধ্যমে কেএনএফ কী বার্তা দিতে চাচ্ছে?
বাংলাদেশ থেকে পার্বত্যাঞ্চলকে পৃথক করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই কুকি-চিনসহ সকল সন্ত্রাসী সংগঠন ঐক্যবদ্ধ তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। “কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টস” নাম দেয়ার কারণে ভারতের মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে বসবাসকারী বিভিন্ন কুকি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ‘সশস্ত্র’ ও বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাদের একটা যোগাযোগ আছে সেটা তারা এরই মধ্যে স্বীকার করেছে। আবার মিয়ানমারের চিন রাজ্যে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গেও তাদের একটা সংযোগ আছে। পার্বত্যাঞ্চল থেকে কিছু সেনা ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ার কারণে আজ তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চরম দুঃসাহসও দেখাচ্ছে? অনেকেই মনে করেন, বহিঃবিশ্বের কোনো কোনো দেশ হয়ত তাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। এত অল্প সময়ে সংগঠিত হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা ও দিনেদুপুরে ব্যাংক ডাকাতি করার সাহস পাচ্ছে তা দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। কুকি চিনের সঙ্গে জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র কিছু নেতার ইন্ধন আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের বাম ধারার কিছু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেও কুকি চিনের সখ্যতা রয়েছে।
কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম নিজেই রহস্যজনক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি একজন গ্রাজুয়েট। তিনি বম সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংগঠক হওয়া একজন তরুণ। কেএনএফ এর মতো সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন তা নিয়েও দেশের সচেতন নাগরিকরা হতাশ! তার মতো যুবকের সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দেয়া নিয়ে চলছে নানান বিচার-বিশ্লেষণ। ইতোমধ্যে বম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসেবে কেএনএফ সন্ত্রাসী পার্টি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে। কেনএফের তাদের ফেসবুক ওয়ালে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির কয়েকটা উপজেলা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র “কুকি-চিন স্টেট” করার ঘোষণা দিয়ে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার শামিল।
এছাড়াও কেএনএফ-এর শতাধিক সদস্যকে ভারতের মণিপুর রাজ্যে পাঠিয়ে কুকি বিদ্রোহীদের দ্বারা সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনে “কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি” (কেএনএফ) গঠন করে নিজেদেরকে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে জানান দিয়েছে। তথাপি সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা, ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্রলুট, অপহরণ এবং উন্মুক্তভাবে সশস্ত্র মহড়া অতীতের সকল ঘটনাকে হার মানিয়েছে। উল্লেখ্য, কেএনএফ এর সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করা হয়, যারা ইতিমধ্যে দু‘দফা শান্তি সভা করেছে, পরবর্তী শান্তি সভা হওয়ার কথা ছিল ৫ এপ্রিল এবং ২২ এপ্রিল। একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে উভয়পক্ষ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। এরকম একটি সময়ে কেএনএফ কেন হঠাৎ করে শান্তি আলোচনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে এত বড় সশস্ত্র শোডাউন করল তা নিয়ে চলছে চুলচেঁড়া বিশ্লেষণ।
ভারতের মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে বসবাসকারী বিভিন্ন কুকি জনগোষ্ঠীর ‘সশস্ত্র’ ও বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে কেএনএফের একটা যোগাযোগ আছে সেটা তারা এরই মধ্যে স্বীকার করেছে। আবার মিয়ানমারের চিন রাজ্যে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গেও তাদের একটা সংযোগ আছে। যেহেতু ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গে স্থানীয় হিন্দু মেইতেইদের সশস্ত্র বিরোধ চলছে এবং সেখানে কুকিরা একটা শক্ত প্রতিরোধ তৈরি করছে। আবার মিয়ানমারের চিন রাজ্যে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স তুমুল লড়াই করছে এবং এ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জান্তা বাহিনীকে পরাজিত করে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স একের পর এক টাউন দখল করছে। ভারতে কুকিরা এবং মিয়ানমারের চিনরা যখন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করছে, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ৩য় দফা শান্তি আলোচনায় না বসে মায়ানমার ও মনিপুরের সশস্ত্র বিদ্রোহিদের মতো সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করতে চেয়েছিলো। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের নামে আত্মসমর্পণ না করে কেএনএফ সশস্ত্র শোডাউন করেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা পরবর্তিতে ব্যাংক ডাকাতি ও সশস্ত্র মহড়া দিয়ে শক্তিমত্তার শোডাউন করে পার্বত্য অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছে।
পার্বত্য তিন জেলায় বিদেশি এনজিওগুলো সেবামূলক কর্মকান্ডের উপর নজরদারি প্রয়োজন। বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রম ও তাদের উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ অঞ্চলের কুকি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত জনগোষ্ঠীর লোকজন মূলত খ্রিষ্টান। ভারত ও মিয়ানমারের কুকি চিন জনগোষ্ঠীও খ্রিষ্টান। এ অঞ্চলের খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সরকার পুরো বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে কেএনএফ-এর সাথে সব ধরনের শান্তি আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। কম্বাইন অপারেশনের মধ্য দিয়ে কেএনএফকে নির্মূল করার অভিযান ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এই ঘটনার পর থেকে কেএনএফ এর সদস্যদের রীতিমতো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, এবং মিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী নাথান বম ইতোমধ্যে ভারতের মিজোরামে পালিয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক