শাফি আহমদ
আধুনিক ঢাকা নগরীতে নতুন সংযোজিত হলো উড়ালসড়ক। ইংরেজিতে এর নাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। মেট্রোরেল চালুর পর এই উড়ালসড়ক চালু রাজধানী নগরীর যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেরে বালা নগরে পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে ঢাকা দ্রুতগতির উড়ালসড়কের একাংশের উদ্বোধন করে বলেন, নগরীর বাসিন্দা এবং এই নগরীতে যারা ভ্রমনে বা কাজে আসবেন তাদের জন্য এটা আমাদের উপহার। এটা যোগাযোগ ব্যবস্থায় মাইলফলক হয়ে থাকবে।
কাওলা থেকে বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর ও মানিকনগর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এই উড়ালসড়কটি সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগ (পিপিপি) নির্মিত। পুরো উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। উদ্বোধন হয়েছে কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার। রোববার থেকে টোল দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচল শুরু করেছে। এতে তিন ঢাকার অটোরিকশা, মোটর সাইকেল ও সাইকেল চলতে পারবে না। পথচারীদের হাঁটারও ব্যবস্থা রাখা হয়নি। উদ্বোধন হওয়া সাড়ে ১১ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সর্বোচ্চ ১২ মিনিট সময় লাগছে। ফলে রাজধানীতে চলতে গিয়ে যে কর্মঘন্টা নষ্ট হয় তা অনেকটা লাঘব হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যাত্রা শুরু
রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন এই বড় উড়ালসড়ক নির্মাণের একটি দীর্ঘ গল্প রয়েছে। নানা জটিলতা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের কারণেই।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি সেতু বিভাগের প্রথম এবং দেশের বৃহত্তম পিপিপি প্রকল্প। ২০০৯ সালে তৎকালিন যোগাযোগমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ যে কয়টি মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন তার মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছিল অন্যতম। তারই ধারাবাহিকতায় প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি ইতাল-থাই কোম্পানীর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী তিন বছরে কাজটি শেষ করার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ ২০১৪ এর নির্বাচনের আগেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এতে ঋণ প্রদানের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা ও আইডিবি সম্মত হয়। নকশা অনুযায়ী বক্সগার্ডে এ এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মিত হবে। বক্স গার্ডার দেখতে সুন্দর। মূল্য অপেক্ষাকৃত বেশি এবং অপরটি আইগার্ডার দেখতে তত ভালো নয় এবং খরচ কম। বক্সগার্ডারগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরির জন্য আশুলিয়ায় যমুনাগ্রুপের একটি জায়গাও চিহ্নিত করা হয়েছিল। এখান থেকে বক্সগার্ডার তৈরী করে এক্সপ্রেসওয়েতে সংযোজন করা হবে।
এই বক্সগার্ডারে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছিল। তৎকালিন যোগাযোগমন্ত্রী জমি অধিগ্রহণসহ সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি সংস্থার সাথে সমন্বয় করে কাজটি দ্রুততর করেছিলেন। এক্সপ্রেসওয়ের এলাইনমেন্টের জন্য যে সংস্থা/বিভাগের জায়গার প্রয়োজন হয়েছে- সবাই তা দিতে ঐক্যমত পোষণ করেন। তৎকালিন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, স্থানীয় এমপি ও তৎকালিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন, তৎকালিন মেয়র ও সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট সবাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। সামগ্রিকভাবে তৎকালিন যোগাযোগমন্ত্রী এক্সপ্রেসওয়েটি ২০১৪ সালের মধ্যে চালু করার টার্গেট নিয়ে যথাযথভাবে কাজ এগিয়ে নিয়েছিলেন।
কিন্তু এক অদৃশ্য কারনে মিথ্যা অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যায়। বিশ্বব্যাংকের তৎকালিন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জুলিখ বোর্ড সভার অনুমোদন না দিয়ে এককভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করেন। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অর্থায়ন থেকেও সরে যায়। শুধু তাই নয় আইএমএফ, এডিবি, জাইকা, আইডিবিও যাতে এক্সপ্রেসওয়েতে অর্থায়ন না করে তাতে প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বব্যাংক। ফলে ইতাল-থাই কোম্পানি সে সময় অর্থ যোগাড় করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে চীনা প্রতিষ্ঠান শেনডং ও সিনোহাইড্রো বিনিয়োগে এগিয়ে আসলে এক্সপ্রেসওয়ের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। অথচ শেনডং বা সিনোহাইড্রো প্রথম টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি। জয়েন্ট ভেঞ্চার হিসেবেও তাদের নাম ছিল না।
কিন্তু এর মধ্যে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ নিজস্ব অর্থায়নে শুরু করলে শেনডং ও সিনোহাইড্রোর স্বপক্ষে চায়না এক্সজিম ব্যাংক এবং আইসিবিসি ঋণ প্রদানে এগিয়ে আসে এবং ২০১৩ সালে ১৫ ডিসেম্বর সেতু বিভাগ আবার নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে তৎকালিন যোগাযোগমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে যে ঐক্যমত সৃষ্টি করেছিলেন- তা ভেঙ্গে যায়। এক্ষেত্রে মেয়রের সহযোগিতা দৃশ্যমান ছিল না। স্থানীয় এমপিসহ রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দও নানা আপত্তি তোলে। ফলে যারা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা যথাযথভাবে সমন্বয় করতে পারেননি। এ সমন্বয়হীনতার কারণেও এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণকাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়।
এই এক্সপ্রেসওয়েটি বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালি পর্যন্ত মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এছাড়া ৩১টি র্যাম্পসহ ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ওভারপাসসহ মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। গত শনিবার বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশ ১১ দশমিক ৫ কি. মি. চালু হয়েছে। সম্পূর্ণ এক্সপ্রেসওয়েটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। ১২ বছরে এ প্রকল্প সংশোধন হয়েছে ৫ বার। ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ গুন। এতে ব্যয় দাড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, নানা অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার কারনে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। এতে জনদুর্ভোগ বেড়েছে এবং ব্যয়ও বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাধাসহ দেশীয় বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত কাংখিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি গত শনিবার উদ্বোধন করেছেন। এর ফলে এক্সপ্রেসওয়েটির একাংশ চালু হলো। এতে নগরবাসীর মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তা অবর্ননীয়। এ কৃতিত্ব এককভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাঁর উদ্যোগের কারণে ঢাকাবাসীর যান চলাচলসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ এক্সপ্রেসওয়েটি একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।